ফোন পেয়ে আকাশ থেকে পড়লেন ইছাপুরের নিতাই শীল! ‘‘আমি! ১ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকার সোনা কিনেছি! কবে? ৮ নভেম্বর? কই, না তো!’’
বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজের অফিসে বসেই আয়কর দফতরের ফোন পান নিতাইবাবু।
সাধারণ মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবীর জীবন। যাবতীয় কর দিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচেন।
তবে আয়করের ফোন কেন!
কারণ শুনে তো আরও অবাক। নোট-নাকচের ঘোষণার দিন নিতাইবাবু যে কলকাতার
নামকরা একটি স্বর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে সোনা কেনেননি, তা আগেই আন্দাজ করেছিলেন
আয়কর দফতরের কর্তারা। শুধু নিতাইবাবু নন, গত মঙ্গলবার থেকে ওই
প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দোকানে হানা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করা গুচ্ছ গুচ্ছ বিলে
যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের অনেকেই প্রকৃত ক্রেতা নন বলেই ধারণা আয়কর
অফিসারদের। বস্তুত বৃহস্পতিবারই হাতেকলমে তার একাধিক প্রমাণ মিলেছে।
নিতাইবাবুর নাম ও ফোন নম্বর লেখা বিল বলছে, সোনা কেনার জন্য ৮ নভেম্বর ১
লক্ষ ৭৭ হাজার ৭৩১ টাকা অগ্রিম দিয়েছেন তিনি। কয়েক দিন পরে তাঁর বাড়িতে
সোনার লকেট ও রুপোর কয়েন পাঠানো হয়েছে। ওই একই দিনে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার ৯৯৯
টাকা মূল্যের সোনার গয়না কেনার বিল রয়েছে শর্বরী তরফদারের নামে। সেই
সূত্রেই বুধবার গড়িয়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হন আয়কর অফিসারেরা।
নিতাইবাবুর মতো তিনিও অবাক! বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারকে ফোনে শর্বরীদেবী
বলেন, ‘‘আমাদের মতো মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, যাঁরা নিয়মিত কর দিই— তাঁদের
বাড়িতে আয়করের লোকজন আসাটা খুবই অপমানজনক। এ ভাবে আমার নামে ভুয়ো বিল
বানানোর জন্য আমি আদালত পর্যন্ত যেতে রাজি।’’ আয়কর দফতরকে এ কথা লিখিত
ভাবেও জানিয়েছেন শর্বরীদেবী।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ওই স্বর্ণ
প্রতিষ্ঠানের অফিস, দোকান এবং কর্তাদের বাড়িতেও মঙ্গলবার একই সঙ্গে হানা
দেন আয়কর অফিসারেরা। তার পর থেকেই শুরু হয় নথি বাজেয়াপ্ত করার কাজ। সেই নথি
ঘাঁটতে গিয়েই জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের অনলাইন তথ্যভাণ্ডারে ৫ লক্ষ গ্রাহকের
নাম ও ফোন নম্বর রয়েছে। যিনিই ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু কিনেছেন, তা
সামান্য একটা কানের দুল হলেও, তাঁর নাম ও মোবাইল নম্বর ঢুকে পড়েছে ওই
তথ্যভাণ্ডারে। অভিযোগ, নরেন্দ্র মোদী নোট বাতিলের ঘোষণা করার পরেই অনেক
কালো টাকার কারবারি অচল হয়ে যাওয়া নোটে সোনা কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের
সাহায্য করে ওই প্রতিষ্ঠান। তথ্যভাণ্ডারে থাকা পুরনো গ্রাহকদের নামে বিল
তৈরি হয় ভূরি ভূরি।
আয়কর দফতরের দাবি, নোট বাতিলের পরের দিন, অর্থাৎ ৯ নভেম্বর, প্রায় দু’শো
কোটি টাকার সোনা বিক্রি করেছে ওই প্রতিষ্ঠান। যার বেশির ভাগটাই হয়েছে
পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে। কিন্তু তখন সরকারের ছাড় দেওয়া কিছু ক্ষেত্রে
ছাড়া ওই নোট আদানপ্রদান বেআইনি ছিল। তাই আইন বাঁচাতে বেচাকেনা দেখানো
হয়েছে ৮ নভেম্বর তারিখে। সে জন্য বিল তৈরির সফ্টঅয়্যার পাল্টানো হয়েছিল
বলে দাবি আয়কর অফিসারদের।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, জেরার মুখে ওই স্বর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্তারা
জানিয়েছেন, ৮ নভেম্বর নোট বাতিলের ঘোষণার পরে রাতেই তাঁদের কাছে একাধিক
ব্যবসায়ীর ফোন আসে। প্রত্যেকেই চান, পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট দিয়ে সোনা
কিনতে। এই প্রলোভনে পা দিয়ে পরের দিন বাতিল নোট নিয়ে সোনা বিক্রি শুরু হয়।
যার বিনিময়ে নেওয়া হয় চড়া কমিশন। আয়কর দফতরের দাবি— শুধু কলকাতা নয়, সারা
দেশ জুড়ে এই স্বর্ণ প্রতিষ্ঠানের যত শো-রুম রয়েছে, তাঁদের অধীনে থাকা সব
ফ্র্যাঞ্চাইজির ম্যানেজারদের কাছে এসএমএস এবং হোয়াটসঅ্যাপ মারফত নির্দেশ
পাঠানো হয় যে, ‘ব্যাক ডেট’-এ ভুয়ো বিল বানিয়ে সোনা বিক্রি করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু সোনার দোকানেই এ ভাবে লেনদেন করে কালো টাকার
ভাণ্ডার বাঁচানোর চেষ্টা হয়েছে বলে আয়কর কর্তাদের অভিমত। সেই বেআইনি
কারবারের পর্দা ফাঁসে তদন্তও শুরু হয়েছে। তার জালেই ধরা পড়েছে কলকাতার ওই
স্বর্ণ প্রতিষ্ঠান। তাদের দফতর থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া নথি ধরে ধরে চলছে যাচাই
পর্ব।
আয়কর দফতরের দাবি, ৯ নভেম্বর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এক ব্যক্তি ৬ কোটি টাকা
নগদ দিয়ে সোনা কিনতে চান। কিন্তু একটি মাত্র বিলে কেনাকাটা হলে আয়করের
জেরার মুখে পড়তে হতে পারে আন্দাজ করেই ২ লক্ষ টাকার কম মূল্যের বিল বানানো
শুরু হয়। কারণ ২ লক্ষ টাকার কম দামের সোনা কিনতে প্যান কার্ডের দরকার হয়
না। এক আয়কর অফিসারের কথায়, ‘‘৬ কোটি টাকার জন্য তিন হাজার বিল বানানো
হয়েছে, যার পুরোটাই ভুয়ো।
আমরা প্রতিটি বিল ধরে ফোন করছি। যাঁকেই ফোন করছি, তিনিই আকাশ থেকে পড়ছেন!’’
আমরা প্রতিটি বিল ধরে ফোন করছি। যাঁকেই ফোন করছি, তিনিই আকাশ থেকে পড়ছেন!’’
ঠিক যেমন নিতাইবাবু। এ দিন আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘আমার বিয়ে হয়েছে
বছর দশেক আগে। বিয়ের আগে কিছু সোনা কিনেছিলাম। তবে ওই দোকান থেকেই
কিনেছিলাম কি না, এত দিন বাদে ঠিক মনে নেই। তার পরে আর কখনও সোনাই কিনিনি।
পুরো বিষয়টাই কেমন ধোঁয়াশা বলে মনে হচ্ছে।’’source:anandabazar.com
0 comments:
Post a Comment