রমজান মাসের শারীরিক জটিলতা ও তার সমাধান জেনে নিন

সংযমের মাস রমজান। সেহ্‌রী, ইফতার, নামায ও পবিত্রতার মধ্য দিয়ে পার হয়ে যায় এক মাস। রোজা রাখার জন্য এই মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে। সকাল, বিকাল, রাত এমনকি সারাদিন একটু একটু করে খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করে প্রত্যেক মুসলমানকেই একটি বাধাধরা নিয়মে চলে আসতে হয়। সেই নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে চলার সহায়ক হিসেবে আমাদের এই প্রচেষ্টা।

সেহ্‌রীতে কী খাবেন?
দিনের শুরু হয় সেহ্‌রী দিয়ে। তাই সেহ্‌রীর খাদ্য তালিকায় প্রোটিন সমৃদ্ধ, আঁশযুক্ত, সুষম, দ্রুত হজম হয়ে যায় না এমন খাবার থাকা চাই। সেই সাথে অবশ্যই যথেষ্ট পরিমানে পানি খাওয়া উচিৎ। সেহ্‌রীর আদর্শ কিছু খাবারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ
  • আঁশযুক্ত খাবার- গম বা গম থেকে তৈরি খাবার, রুটি, শাকসবজি, ফল, বাদাম ইত্যাদি।
  • সুষম খাবার- লক্ষ রাখতে হবে সেহ্‌রীর খাদ্য তালিকায় যেন সব ধরনের পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার থাকে। যেমন ফলমূল, শাকসবজি, কম চর্বিযুক্ত মাংস বা মাছ, ভাত বা রুটি, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ডিম ইত্যাদি।
একটি সম্পূর্ণ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর সেহ্‌রীর খাদ্য তালিকা হতে পারেঃ
  • সিদ্ধ ডিম- ১ টি
  • কমলা বা কলা- ১ টি
  • রুটি ২ টি বা ভাত ১ কাপের মতো
  • শাকসবজি- এক বা একাধিক প্রকার
  • লো ফ্যাট মিল্ক- ১ গ্লাস
সেহ্‌রীতে কী কী এড়িয়ে চলা উচিৎ?
সেহ্‌রীতে ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবার, মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহন ও অতিরিক্ত চা বা কফি খাওয়া উচিৎ নয়। অনেকেই সারাদিন ধূমপান করতে পারবেন না বিধায় সেহ্‌রীতে একাধিক সিগারেট খান। যারা ধূমপান করেন তাদের জানিয়ে রাখি, রমজান মাস ধূমপান ত্যাগ করার একটি মোক্ষম সময়। রোজা শুরু হওয়ার ১০-১৫ দিন আগে থেকেই একটু একটু করে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করুন। রোজার সময় ধূমপান বর্জন করতে চেষ্টা করুন।
ইফতারে কী খাবেন?
ইফতারকে ঘিরে বাঙালি মুসলমানদের আয়োজনের যেন শেষ নেই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে প্রতিদিন রোজা শেষে ইফতারে বসেন সবাই। ইফতারে সাধারণত পুষ্টিগুণের চেয়ে মুখের স্বাদকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর ইফতার পুরো রমজান মাস জুড়ে আপনাকে সুস্থ ও সবল রাখবে। চলুন জেনে নেয়া যাক একটি পুষ্টিগুণসম্পন্ন ইফতারের টেবিলে কী কী থাকা জরুরী।
  • খেজুর- একটি আদর্শ ইফতারের খাদ্য তালিকায় প্রথমেই রাখা হয় খেজুর। সারাদিনের দুর্বলতা দূর করতে ও শরীরকে সুস্থ সবল রাখতে খেজুরের জুড়ি নেই।
  • পানি- বলা বাহুল্য, রোজা খুলে এক রাশ খাবারের মধ্যে প্রথমেই যেদিকে চোখ যায় তা হচ্ছে পানি। এক্ষেত্রে কিছু খেজুর খেয়ে পরিমান মত পানি পান করে নিন।
  • স্যুপ- পিয়াজু, বেগুনী, চপ এসব ভাজাপোড়া দিয়ে রোজা না খুলে টাটকা সবজিতে ভরা এক বাটি উষ্ণ স্যুপ খেয়ে নিন। স্যুপ একদিকে যেমন পানির অভাব পূরণ করে, অন্যদিকে পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে ও খাওয়ার আগ্রহ তৈরি করে।
  • সালাদ- রোজার মাসে ভাজাপোড়া ও মশলাযুক্ত খাবারের ভিড়ে শাক-সবজি খুব কম খাওয়া হয়। তাই ইফতারে বেশি করে সালাদ খেয়ে সেই অভাব পূরণ করুন।
খেজুর, পানি, স্যুপ ও সালাদ দিয়ে শুরু করুন আপনার প্রতিদিনের ইফতার। এরপর আপনি আপনার পছন্দ মতো খাবার খেতে পারেন।
রমজান মাসে কোন কোন অভ্যাসগুলো এড়িয়ে চলবেন?
১। ইফতারে হঠাৎ করে প্রচুর খাবেন না।
২। ইফতারের পর চা, কফি ও সোডা জাতীয় খাবার গ্রহন থেকে বিরত থাকুন। এগুলোর পরিবর্তে প্রচুর পানি পান করুন।
৩। অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার খাবেন না। এগুলো বুক জ্বালা ও বদ হজমের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
৪। সেহ্‌রীতে অতিরিক্ত লবন জাতীয় খাবার যেমন আচার, সল্টেড বিস্কিট ইত্যাদি খাওয়া উচিৎ নয়।
৫। সেহ্‌রীতে অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার খেলে বেশি পিপাসা পায়।
৬। সেহ্‌রীতে অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
রমজান মাসের টিপস্!
১। সারাদিন তৃষ্ণামুক্ত থাকতে সেহ্‌রী ও ইফতারে চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
২। ইফতারের পর কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করুন।
৩। নিয়মিত নামায আদায় করুন।
৪। যাদের মাথা ব্যথা ও ঝিম ঝিম করে, তারা ইফতারের শুরুতে ৪-৫ টি খেজুর খেয়ে পানি পান করুন।
৫। স্যুপ, সালাদ ও খেজুর খেয়ে যদি খুব তাড়াতাড়ি আপনার ক্ষুধা মিটে যায়, সেক্ষেত্রে ইফতারের বাকি খাবার মাগরিবের নামায আদায় করে খেতে পারেন। এর ফলে আপনার হজমক্রিয়া নিয়মত্রান্ত্রিক উপায়ে হবে।
৬। যাদের চা খাওয়ার অভ্যাস আছে তারা একটি সুষম ইফতার গ্রহণের ২ ঘণ্টা পরে ১ কাপ চা খেতে পারেন।
৭। ভাজাপোড়া খাবারের পরিবর্তে বেক করা খাবার খেতে পারেন।
৮। রমজান মাস ধূমপান বর্জনের একটি সুবর্ণ সুযোগ। রোজা শুরু হওয়ার ১০-১৫ দিন আগে থেকেই একটু একটু করে ধূমপান কমিয়ে দিন। পুরো রমজান মাস নিজেকে ধূমপানমুক্ত রাখতে চেষ্টা করুন।
রমজান মাসে কীভাবে আপনার শারীরিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন?
দীর্ঘদিন ধরে যারা বিভিন্ন রকম রোগে ভুগছেন, রমজান মাসে রোজা রাখতে তারা অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। এই সব রোগ এড়িয়ে আপনারা যেন যথাসম্ভব সুস্থ অবস্থায় রোজা রাখতে পারেন, সেজন্য নিম্নে কিছু টিপস্‌ দেয়া হোলঃ
  • অ্যাসিডিটি- অ্যাসিডিটিতে ভুগছেন না এমন ব্যক্তি খুব কম দেখা যায়। অ্যাসিডিটি নিয়ে রোজা রাখা যেমন কষ্টকর তেমনি কখনও কখনও তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। একটি পরিকল্পিত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস আপনাকে অ্যাসিডিটি থেকে রেহাই দিতে পারে। প্রচুর পানি পান করুন, ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং নিয়ম মেনে চলুন। প্রয়োজন হলে সেহ্‌রীর আগে এবং ইফতারের ২-৩ ঘণ্টা পরে নিয়মিত অমিপ্রাজল জাতীয় ঔষধ গ্রহন করুন।
  • ডিসপেপসিয়া- প্রচুর পানি পান করুন। অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলুন।
  • হাইপোটেনশন- যারা লো ব্লাড প্রেসারে ভোগেন, তারা অনেকেই মনে করেন রোজা রাখলে তারা আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারেন এবং ব্লাড প্রেসার আরও নেমে যেতে পারে। আপনাদের জানাচ্ছি, লো প্রেসার থাকলেও আপনারা সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে রোজা রাখতে পারবেন। প্রচুর পানি ও ফল খান। সেহ্‌রী ও ইফতারে নিয়মিত ডিম দুধ খান। চা কফি এড়িয়ে চলুন।
আমি কি রোজা রাখতে পারবো?
  • অনেকেই ধারণা করেন IBS অথবা IBD তে আক্রান্ত রোগীদের রোজা না রাখাই ভাল। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। IBS অথবা IBD তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নির্দ্বিধায় রোজা রাখতে পারেন।
  • ক্রনিক কিডনি ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোজা রাখতে পারেন। তবে শারীরিক সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে রোজা না রাখাই ভাল।
  • ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারেন।
  • যারা তিব্র মাত্রার পেপটিক আলসারে ভুগছেন তাদের জন্য রোজা না রাখাই ভাল। তবে রোগ হিলিং স্টেজে থাকলে উপযুক্ত ঔষধ গ্রহন করে রোজা রাখা সম্ভব।
  • সেহ্‌রী বা ইফতারে কৃমির ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। অনেকে মনে করেন কৃমির ঔষধ খেয়ে সারাদিন খালি পেটে থাকাটা ক্ষতিকর। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
  • ডিজলিপিডেমিয়ার রোগী বা যাদের কোলেস্টেরল বেশি থাকে রোজা রাখা তাদের শরীরের জন্য উপকারী।
  • যাদের কার্ডিয়াক সমস্যা থাকে তারা রোজা রাখতে পারেন। তবে এই সমস্যা যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে, সেক্ষেত্রে রোজা না রাখাই ভাল।
  • রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীরা রোজা রাখতে পারবেন।
রমজান মাসের খাদ্যাভ্যাস ও বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আলোচনা করাই ছিল আমাদের এই পোস্টের উদ্দেশ্য। একটা কথা না বললেই নয়, রোজায় আপনি যতই অসুস্থ থাকুন বা যত রকম জটিলতাই থাকুক না কেন, আপনার খাদ্য ও জীবনযাত্রায় সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে সেগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। নিয়ম মেনে চলুন; সুস্থ থাকুন!source:bdhealth.news

0 comments:

Post a Comment