![]() |
কোরবানি |
কোরবানি: শুধু পশু নয়, আত্মশুদ্ধি ও মুসলিমের সচেতনতার ঈদ ভাবনা | ইসলামের আলো
ঈদুল আযহায় আমরা কি শুধু পশুই কোরবানি দেই? জানুন কোরবানির আসল মর্ম, আত্মশুদ্ধি, যুক্তিসঙ্গত সচেতনতা ও সঠিক আবেগের গুরুত্ব। বর্তমান মুসলিমদের জন্য একটি গভীর বিশ্লেষণ।
ঈদুল আযহা, মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এই উৎসবের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো কোরবানি। প্রতি বছর জিলহজ্ব মাসে সামর্থ্যবান মুসলিমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পশু কোরবানি করেন। কিন্তু আমরা কি কখনো গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, এই কোরবানির তাৎপর্য কি শুধু একটি পশুকে জবাই করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক শিক্ষা? বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন যুক্তিবাদী ও সচেতন মুসলমান হিসেবে আমাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা অপরিহার্য।
কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও মূল চেতনা:
কোরবানির ইতিহাস আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় হজরত ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল (আঃ)-এর স্মৃতিবিজড়িত ঘটনার দিকে। আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য ও ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে গিয়ে হজরত ইবরাহিম (আঃ) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর এই ত্যাগ ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে হজরত ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনাই কোরবানির মূল ভিত্তি।
সুতরাং, কোরবানির মূল চেতনা হলো:
1. আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য (তাওহীদ): জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া।
2. ত্যাগ ও বিসর্জন: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় বস্তু, এমনকি নিজের ভেতরের পশুত্বকে বিসর্জন দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করা।
3. তাকওয়া অর্জন: আল্লাহভীতি ও পরহেজগারি অর্জন করা, যা কোরবানির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, "আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।" (সূরা হজ্ব: ৩৭)
আমরা কি শুধু পশুই কোরবানি দেই?
ظاهریভাবে (ظاهریভাবে) দেখলে মনে হতে পারে আমরা শুধু একটি পশুই জবাই করছি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে, এই পশু কোরবানির মাধ্যমে আমরা আমাদের ভেতরের আরও অনেক কিছুকে কোরবানি দেওয়ার শিক্ষা লাভ করি। একজন সচেতন মুসলমান হিসেবে আমাদের এই বিষয়গুলো অনুধাবন করা জরুরি:
অহংকার ও আত্মম্ভরিতা: কোরবানির মাধ্যমে আমরা আমাদের ভেতরের ‘আমি’ বা অহংকারকে কোরবানি দেই। আল্লাহর সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও অসহায়ত্ব স্বীকার করে বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা পাই।
হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসা: মনের মধ্যে পুষে রাখা যাবতীয় হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ ও দুনিয়াবি মোহকে ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি হয়। কোরবানির গোশত গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে আমরা ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হই।
পাপ ও মন্দ অভ্যাস: আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় পাপ কাজ, মন্দ চিন্তা ও বদ অভ্যাসগুলোকে কোরবানির পশুর রক্তের সাথে যেন ধুয়ে মুছে ফেলার শপথ নিতে পারি। এটি আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ।
কৃপণতা ও স্বার্থপরতা: নিজের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা পশু কোরবানি করে এবং তার গোশত অপরের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে আমরা কৃপণতা ও স্বার্থপরতার মতো চারিত্রিক দুর্বলতাগুলোকেও কোরবানি করি।
প্রিয় বস্তুর মায়া: হজরত ইবরাহিম (আঃ) যেমন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, তেমনি আমাদেরও আল্লাহর রাহে নিজেদের প্রিয় বস্তু, সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বর্তমান মুসলমান ও যুক্তিসঙ্গত সচেতনতা:
আজকের দিনে অনেক মুসলমান কোরবানির মূল চেতনা থেকে সরে এসে এটিকে নিছক একটি প্রথা বা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত করেছেন। কে কত বড় পশু কোরবানি দিল, কার কোরবানির জাঁকজমক কত বেশি – এসব প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া কোরবানির আদর্শের পরিপন্থী। যুক্তিসঙ্গত সচেতনতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
1. উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা: কোরবানি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে, লোক দেখানো বা সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নয়।
2. হালাল উপার্জন: কোরবানির পশু অবশ্যই হালাল অর্থে ক্রয় করতে হবে। হারাম বা সন্দেহযুক্ত অর্থে কোরবানি কবুল হয় না।
3. পশুর প্রতি মানবিক আচরণ: কোরবানির পশুর সাথে মানবিক আচরণ করা, তাকে কষ্ট না দেওয়া ইসলামের শিক্ষা।
4. পরিবেশ সচেতনতা: কোরবানির পর পশুর রক্ত ও বর্জ্য সঠিকভাবে পরিষ্কার করে পরিবেশ দূষণ রোধ করা একজন সচেতন মুসলমানের দায়িত্ব।
5. সামাজিক দায়িত্ব: কোরবানির গোশত বিতরণে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায়দের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই কোরবানির সার্থকতা।
সঠিক আবেগ ও তার প্রয়োগ:
ইসলামে আবেগের স্থান রয়েছে, তবে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত ও সঠিক পথে পরিচালিত। কোরবানির ক্ষেত্রে আমাদের আবেগ যেন লোক দেখানো বা υπεർউৎসাহে (over-enthusiasm) পর্যবসিত না হয়। বরং আমাদের আবেগ কেন্দ্রীভূত হওয়া উচিত:
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতায়: তিনি যে আমাদের সামর্থ্য দিয়েছেন কোরবানি করার, সেজন্য শুকরিয়া আদায় করা।
ত্যাগের আনন্দে: নিজের প্রিয় কিছু আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে পারার মধ্যে যে আধ্যাত্মিক আনন্দ রয়েছে, তা অনুভব করা।
গরিব-দুঃখীর প্রতি সহানুভূতিতে: তাদের কষ্ট লাঘব করার ইচ্ছায় আবেগাপ্লুত হওয়া।
শেষ কথা:
কোরবানি শুধু একটি পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। এটি আমাদের শেখায় ত্যাগ, আত্মসমর্পণ, আত্মশুদ্ধি এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ। একজন বর্তমান যুগের মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো কোরবানির এই অন্তর্নিহিত শিক্ষাকে অনুধাবন করা এবং তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করা। আসুন, আমরা শুধু পশু নয়, আমাদের ভেতরের পশুত্ব, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ ও সকল প্রকার মন্দকে কোরবানি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য বোঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
0 comments:
Post a Comment