![]() |
| মানুষের হাট |
শীতের শেষভোর। গ্রাম্য কাঁচা রাস্তায় কুয়াশা জমে আছে, যেন পৃথিবীটা একটু দেরি করে জেগেছে। ঘুমজড়ানো আলোয় কেউ বুঝতে পারে না কে আসছে, কে যাচ্ছে। ঠিক সেই অর্ধঅন্ধকারেই হাঁটছিলেন এক বৃদ্ধ—নাম তার কাজেম আলী। বয়স সত্তরের বেশি, গায়ের উপর পুরোনো চাদর, হাতে জীর্ণ লাঠি, আর কাঁধে একটি ছোট কাপড়ের ব্যাগ।
আজ তিনি এক অদ্ভুত উদ্দেশ্য নিয়ে বের হয়েছেন—
তিনি যাচ্ছেন “মানুষের হাটে”।
এই হাট আসলে কোথায়, কেমন—কেউ জানে না। কিন্তু কাজেম আলী বিশ্বাস করতেন, কোথাও না কোথাও এমন একটি জায়গা আছেই, যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে দাম দেওয়া হয়। যেখানে বয়স, দুর্বলতা বা প্রয়োজন—কাউকে ছোট করে না। যেখানে হৃদয়ের ক্ষুদ্র চাহিদাগুলো বিক্রি করতে হয় না, বরং কেউ হয়তো নির্দ্বিধায় কিনে নেয় একটু সময়, একটু সঙ্গ, একটু কথা।
পথে তিনি একটু ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশের পুরোনো বটগাছটার নিচে বসতেই দেখলেন—একজন যুবক কাছে আসছে। তার মুখে বিস্ময়ের আভা।
— চাচা, এত সকালে একা একা কোথায় যান?
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন—
— মানুষের হাটে যাচ্ছি বাবা।
যুবক হাসল ভেবে যে এটা হয়তো কোনো লোকাল হাট।
— মানুষের হাট?
কাজেম আলী মাথা নিচু করলেন।
— হ্যাঁ বাবা… যেখানে মানুষের দাম মানুষই নির্ধারণ করে। যেখানে হৃদয়ের কথা শোনার লোক পাওয়া যায়। যেখানে বয়স বাড়লে মানুষকে ফেলে দেওয়া হয় না।
যুবক থমকে গেল। প্রশ্ন করল—
— চাচা, আপনার কেউ নেই?
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বললেন—
— বাবা, আমার দুই ছেলে… বড় শহরে থাকে। তাদের বড় বাড়ি হয়েছে, বড় গাড়ি হয়েছে—কিন্তু মনটা ছোট হয়ে গেছে। তাদের সংসারে আমার জন্য জায়গা নেই।
একসময় তারা আমার হাত ধরে হাঁটত, আর এখন আমি তাদের সামনে দাঁড়ালেই তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তাই ভাবলাম, মানুষের হাটে যাই… হয়তো কোনো হৃদয় আমাকে আবার মানুষ হিসেবে গ্রহণ করবে।
কথাটা এত সাধারণ, অথচ এত কষ্টের—যুবকের বুকটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
বটগাছের পাতায় হালকা বাতাসের শব্দ।
ভোরের কুয়াশা একটু একটু করে পাতলা হচ্ছে।
যুবক ধীরে ধীরে বৃদ্ধের পাশে বসে পড়ল।
— চাচা… আপনি জানেন, মানুষের হাট এখানে নয়। এটা কোথাও আলাদা কোনো জায়গা না। মানুষের হাট—মানুষের ভেতরেই থাকে। মনেই থাকে।
বৃদ্ধ চোখ তুললেন।
যুবকের কণ্ঠে সত্যের মতো উষ্ণতা।
— চাচা, আজ আপনি আমার বাড়ি যাবেন। আপনি চাইলে আবার হাসবেন, চাইলে গল্প করবেন। আমার নিজের কোনো হাট নেই, কিন্তু আমার হৃদয়ে জায়গাটা খালি আছে। আপনি সেখানে থাকলে আমারই বরং ভালো লাগবে।
কাজেম আলীর চোখে পানি চলে এল।
কম্পিত গলায় বললেন—
— তাহলে বুঝি আজই মানুষের হাট পেলাম বাবা?
যুবক তার হাত ধরে বলল—
— হ্যাঁ চাচা… আজ হাট নেই, আছে সঙ্গ। আছে সম্মান। আর আছে আপনার মতো একজন মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে দেখার মন।
দু’জন হাঁটতে শুরু করল।
ভোরের সূর্য ধীরে ধীরে আকাশে উঠছে।
রাস্তা একই—কিন্তু অনুভূতি বদলে গেছে।
বৃদ্ধের মনে প্রথমবারের মতো বিশ্বাস জন্মালো—
মানুষের হাট কোথাও দূরে নয়…
যেখানে হৃদয় খোলা থাকে,
যেখানে মানুষ মানুষকে গ্রহণ করে—
সেখানেই মানুষের হাট বসে।

0 comments:
Post a Comment