“আমি বিচার চাই স্যার। আমি আর কিছুই চাইনা। স্যার, ওরা আমার মেয়ের আর আমার মান সম্মান সব শেষ কইরা দিছে।
স্যার, আমার মেয়ের মানসম্মানের দিকে তাকাইয়া আমি আপোষ মিমাংসায় রাজী হইছিলাম। বেশ কয়েকদিন শালিস বসছে। শালিসটা এই উঠানেই হইছে স্যার। গেরামের কয়েকশ মানুষ আছিল। সবাই জানে ঘটনাটি। ও যা করছে সবার সামনেই ও স্বীকার করছে।
গেরামের হজ্ঞলেই কইল যা হবার হইয়া গেছে। আমরা একটা ব্যবস্থা কইরা তোমার মেয়ের সাথে ঐ ছেলের বিয়ে দিয়া দেই। হজ্ঞলের কথায় আমার মাইয়াডার মানসম্মানের দিকে তাকাইয়া আমি আমার মাইয়ারে ঐ ছেলের সাথে বিয়া দিতে রাজী হইছিলাম। আজ কাইল করতে করতে প্রায় দুই হপ্তাহ হইয়া গেছে। ওরা এখন কয় কিছুই নাকি করে নাই। আমারে কয় যা পারস কর গিয়া। বেশী বাড়াবাড়ি করলে নাকি আমারে গেরাম ছাড়া কইরা দিব।
আমি বাধ্য হইয়া আইনের কাছে গেছি স্যার। আমরা গরীব মানুষ। দুনিয়ার কোথাও আমরা বিচার পাই না। গেরামেও আমার বিচারডা কেউ কইরা দিতে পারলনা। আমি জীবনেও কোনদিন কোর্ট কাচারী করি নাই। বাধ্য হইয়া গেছি স্যার। আপনেরা যদি বিচার না করেন তাইলে আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই স্যার।
স্যার, আমার মেয়ে কইছে ঐ পোলার লগে যেন তার বিয়ের কথা আর কেউ না কয়। ও আইয়ে (ইন্টার) বিএ পাশ কইরা তারপর বিয়া করব। ও কয়, ওর যদি বিয়া নাও হয় তাইলেও আর ওরে বিয়া করব না। ঘটনার পর থেইকা আমার মেয়েডা স্বাভাবিক নাই।
দেখছেন তো। কেউ কিছু জিজ্ঞসা করলেই চোখ দিয়ে গড় গড় কইরা পানি পড়তে থাকে। ওর চোখের পানি দেইখা বাবা হইয়া কিভাবে নিজেরে সামলাই কন”।
কথাগুলো হাউ মাউ করে কাদতে কাদতে বলছিলেন ধর্ষনের শিকার এক গ্রাম্য মেয়ের সহজ, সরল, হতভাগ্য পিতা। কথাগুলো তিনি বেশ কয়েকদফায় বলছিলেন এবং প্রতিবারই বলার সময় চোখ দিয়ে গড় গড় করে অশ্রু ঝরছিল।
আজ শুক্রবার মামলা সংক্রান্তে সহকর্মী পংকজের সাথে যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম সেখানে গিয়ে ঘটনার শিকার ভিকটিম এবং এই পিতার আবেগী বর্ণনা আমাকে আবেগাপ্লোত কর দিয়েছিল। ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় আশেপাশের লোকদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে।
ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে এজাহার পড়ে ঘটনা সম্পর্কে একটু নেগেটিভ ধারণা হলেও সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর পালটে যায় পুরো ধারণা। একটি মেয়ে যে আমাদের সমাজে এখনো কতটা অবহেলিত তার বাস্তব সাক্ষী হয়ে রইলাম।
নইলে একটা নরপশু, বিকৃত রুচী সম্পন্ন ধর্ষকের বিচার না চেয়ে তার সাথে ভিকটিমের বিয়ের কথা কিভাবে আসে?
তারা যে লাইসেন্স দিয়ে ধর্ষন কে বৈধতা দিতে যাচ্ছে সেটা কি কেউ কখনো চিন্তা করেছে?
যে মেয়েটি প্রচন্ড রকমের মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে তাকে বিচার শালিসের নামে প্রতিবার পরোক্ষভাবে ধর্ষনের মুখোমুখি করা হচ্ছে সেটা কি কেউ একবারও ভেবেছে ?
অবাক হয়েছি গ্রাম্য মাতাব্বরদের কান্ডজ্ঞানহীন ভূমিকা দেখে। একটি জঘন্য ঘটনার আলামত নষ্টের জন্য যতদিন এদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা না হবে ততদিন এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে আর এরা এলাকায় বিচার শালিসের নামে সাধারণ মানুষদের জিম্মি করে নিজের পকেট ভারী করবে।
আর একটি বিষয় না বললেই নয়, এরকম অসহায়, সহায়সম্বলহীন মানুষের বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল যখন আমার মতই কেউ এবং আমার মত কেউ যখন অন্য কোনভাবে এরকম অসহায়, সহায় সম্বলহীন মানুষের ন্যায় বিচারের পরিবর্তে তাদের উপর অবিচার করে তখন এই মানুষ গুলোর সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তোলে অভিশাপ দেওয়ার কোন দরকার আছে???
নাকি তাদের নীরব অশ্রু টুকুই অব্যক্ত অভিশাপ হয়ে তাদের উপর লানত নিয়ে আসবে???
আর এই লানতই একজন মানুষের সমস্ত সুখ শান্তি কেড়ে নিয়ে অনেক প্রাচুর্যের মধ্যেও দুনিয়াটাকে একটা দোজখখানা করে দিতে পারে।
মামলাটি যেহেতু সহকর্মী পংকজ তদন্ত করছে তাই এইটুকু বলতে পারি শুধু এই ঘটনাটিই না আমরা যে কোন ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার সাথে মামলা তদন্ত করে অসহায় মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কারণ পিবিআই মানেই শুদ্ধ ইনভেস্টিগেশনে অংগীকারবদ্ধ।
ঘটনাটি ধর্ষনের মত সেন্সিটিভ ঘটনা হওয়ায় ডিটেইলস প্রকাশ করতে পারছিনা। ঘটনাটি কোতয়ালী থানাধীন।
সালেহ ইমরান
এস আই
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) রংপুর।
০৩/০৩/২০১৭
শুক্রবার।
0 comments:
Post a Comment