সন্দেহ নেই, বিশ্বের অন্যতম
জনপ্রিয় পানীয়ের তালিকায় চা অবশ্যই উপরের
অবস্থানে থাকবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অনুসারে, পানির পরে বিশ্বে চা হলো সবচেয়ে বেশি পান করা তরল পদার্থ।
অনেকের মতে চা পান শুধু মাত্র একটি অভ্যাস না, এটির কিছু স্বাস্থ্যগুণ রয়েছে বলে মনে হয়।
চা পানের স্বাস্থ্যগত
দিক নিয়ে নানা ধরনের জরিপ ও গবেষণা বছরের পর বছর ধরে চলছে, যার সূত্র ক্লান্তি থেকে
আয়ু বৃদ্ধি পর্যন্ত পরিকল্পিত হয়।
চা মৌলিকভাবে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নামের একটি চিরজীবী গুল্ম থেকে তৈরি হয়।এই ছোট গাছের পাতা এবং তার কুঁড়ি সংগ্রহ করে চা উৎপাদন করা হয়।
সাধারণত, ব্ল্যাক টি বা
র' চা, গ্রিন টি বা সবুজ চা হিসেবে বিভিন্ন নামে পরিচিত। তবে, এই চা গুলি মূলত এই উদ্ভিদ
থেকেই পাওয়া যায় এবং তার চাষ এবং প্রস্তুতি বিভিন্ন উপায়ে, পদ্ধতিতে বা পরিস্থিতিতে
করা হয়ে থাকে।
কফির
পরিবর্তে চা এগিয়ে গিয়েছে?
মূলত ক্যাফেইনের কারণেই চায়ের মতো পানীয়ের দিকে বেশিরভাগ মানুষ ঝুঁকে থাকেন। সকাল সকাল ঘুম তাড়িয়ে তাজা হতে চা অনেকটা ইঞ্জিনের তেলের মতোই কাজ করে।
আরেকটি পানীয় হলেও কফি বেশ জনপ্রিয় হলেও চা থেকে তা কিছুটা পিছিয়ে যায়। এর একটি কারণ হতে পারে এতে থাকা ক্যাফেইনের পরিমাণ।
সমান আকারের একটি কাপ কফিতে যেখানে ৮০ থেকে ১১৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে, সেখানে একই পরিমাণ চায়ে ৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে, তুলনা করলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় অর্ধেকেরও কম।
লন্ডনের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, একদিনে একই পরিমাণের চা-কফি খেলেও মনোযোগের ক্ষেত্রে অন্যান্য ফলাফল দেখা গেছে, তবে রাতে ঘুমানোর সময় কফি খেলে ব্যক্তিদের কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়।
অন্যদিকে, যারা চা পান করেন তাদের ঘুম তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ এবং প্রশান্তিপূর্ণ হয়।
মানসিক চাপ কমাতে
চা পানের মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
এবং সাথে সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি উপাদান এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। ফলে চা পান করলে স্নায়ুগুলি
আরাম পায়।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ যে 'স্ট্রেস কন্ডিশন' বা মানসিক চাপে পড়ে, সেখান থেকে আমাদের শরীরের ভেতরে অক্সাইডস নামের এক ধরনের উপাদান সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলাম।
অন্যদিকে, চায়ের মধ্যে থাকে এন্টিঅক্সিডেন্ট। চায়ের মাধ্যমে শরীরে এন্টিঅক্সিডেন্ট প্রবেশ করলে তা অক্সাইডসগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ব্যক্তি মানসিক চাপ থেকে রেহাই পায় বলে তিনি জানান।
চা একটি প্রাকৃতিক পদার্থ, যা মানুষের মনকে শান্ত করে, শরীর সতেজ করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
চা যে মানুষের স্নায়ুকে শান্ত করে সে বিষয়টি বেশ কিছু গবেষণাতেও পাওয়া গেছে।
এতে দেখা গেছে, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ভেষজ চা পানকারীদের তুলনায় নিয়মিত চা পানকারীরা তুলনামূলক শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
অতএব, আরেকটি গবেষণাতে দেখা গেছে যে, প্রতিদিন যারা অন্তত তিন কাপ চা পান করেন তাদের হতাশার ঝুঁকি চা পান না করা ব্যক্তিদের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম থাকে।
রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
চা যে কেবল মানসিক চাপ কমায়, তা-ই নয়। বিভিন্ন গবেষণায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও চা পানের উপকারিতার দিকটি উঠে এসেছে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন কয়েক কাপ চা পানের ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায়।
এই উপকারিতা ঠিক কতটুকু, সে সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা না গেলেও তা পাঁচ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
চায়ে উপস্থিত অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলো বিপাকে সাহায্য করে, যা শরীরের ইনসুলিনকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে রক্তের গ্লুকোজকে দক্ষতার সঙ্গে সামলায়।
আরেক গবেষণাতে দেখা গেছে, রঙ চা গ্রহণের পর শরীরের কোষ থেকে ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন বের হয়।
আর ইন্সুলিন যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে বের হয় তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
হৃদপিণ্ড ভালো থাকে।
চা পানের আরেকটি উপকারিতা হলো হৃদপিণ্ডের সুরক্ষা।
নেদারল্যান্ডের ১৩ বছরব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি কিছু পরিমাণে হৃদপিণ্ডকেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে নিয়ে করা গবেষণাটিতে দেখা গেছে, দিনে ছয় কাপের বেশি চা পান করা ব্যক্তিদের হৃদরোগের শঙ্কা এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যায়।
প্রতিদিন কয়েক কাপ চা পানের ফলে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্ভব।
যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে পাঁচ লাখ চা পানকারীদের নিয়ে করা আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি চা পান করার সঙ্গে মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, যারা প্রতিদিন দুই কাপ বা তারচেয়ে বেশি চা পান করেন তাদের চা পান করেন না - এমন লোকদের তুলনায় যে কোনও কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি নয় থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত কম থাকে।
এছাড়া, চা পানের ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকিও কমে যায়।
এই অবস্থায়, গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, চায়ের তাপমাত্রা, দুধ বা চিনি সহযোগিতা কিংবা ক্যাফেইনের প্রভাবের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় এই ফলাফল পাওয়া গেছে।
ক্যান্সার
প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে চা পরিচিত।
চা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে গুনগান পায়।
বাংলাদেশ সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ‘চা’ নিয়ে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ হয়েছে যে, চায়ে পুষ্টিগুণ কম থাকলেও, পলিফেনলস, ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ক্যাটেচিন নামক উপাদানের উপস্থিতি ফ্রি রেডিক্যালস তৈরির প্রতি বাধা সৃষ্টি করে এবং কোষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনেকটাই বাধা দেয়।
চা খাওয়ার ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়। এছাড়াও, চায়ে উপস্থিত পলিফেনলসের পরিমাণ ২৫ শতাংশেরও বেশি থাকায় এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
চা
পানের ক্ষতিকর দিকের বিষয়ে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অবস্থা উল্লেখ করা হচ্ছে।
যেহেতু চায়ে ক্যাফেইন আছে, তাই এটি অতিরিক্ত গ্রহণ করলে ঘুমের সমস্যা তৈরি করতে পারে। চায়ে উপস্থিত থিওফাইলিন নামক একটি রাসায়নিক উপাদান মস্তিষ্কে ডিহাইড্রেশনের কারণ হতে পারে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য সৃষ্টি করে এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাছাড়া, গর্ভবতী মহিলারা চা পান করা থেকে বিরত থাকতে উচিত, কারণ এটি গর্ভকালীন সময়ে ভ্রুণের বিকাশে বাধা উত্পন্ন করতে পারে এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তবে, চা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
চা পান করার নিয়মগুলি মেনে চলা এবং পরামর্শ মেনে চলা এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আছে যেগুলি চা পানকারীদের স্বাস্থ্যসম্পর্কে দেখভাল করায় সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও, চা খাবারের অন্তত আধা ঘণ্টা আগে খাওয়ার উপর দিক্কা দেওয়া হচ্ছে, এবং চায়ে দুধ বা চিনি মিলাতে হবে না কারণ এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা প্রভাবিত করতে পারে। চা খাবারের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি ভাস্কুলার সিস্টেমের উপর অসুখকর প্রভাব ফেলতে পারে। চা হজম প্রক্রিয়ায় সহায়ক হতে পারে এবং চা খাওয়ার সময়ে ভিটামিন সি খেলে চা এর গুণাগুণ বাড়তে পারে। তবে, পুরোপুরি গরম চায়ে ভিটামিন সি মেশালে এর কার্যকারিতা কমে যায়, তাই ভিটামিন সি চা খাওয়ার ঠিক সময়ে মেশানো উচিত।
সংবাদ উৎস:বিবিসি নিউজ বাংলা
0 comments:
Post a Comment